• ঢাকা
  • |
  • বুধবার ১৪ই কার্তিক ১৪৩২ রাত ১০:৩২:৪৭ (29-Oct-2025)
  • - ৩৩° সে:

নানা প্রোপাগান্ডার শিকার এশিয়াটিক, ক্লায়েন্টরা বিপাকে


বুধবার ২৯শে অক্টোবর ২০২৫ সন্ধ্যা ০৭:৫০



নানা প্রোপাগান্ডার শিকার এশিয়াটিক, ক্লায়েন্টরা বিপাকে

নানা প্রোপাগান্ডার শিকার এশিয়াটিক, ক্লায়েন্টরা বিপাকে

বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন ও ব্র্যান্ড কমিউনিকেশন খাতের অন্যতম শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি ও এর অন্যতম স্বত্বাধিকারী গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, প্রোপাগান্ডা ও মিডিয়া ট্রায়াল থামছে না। এমনকি, জুলাই আন্দোলনে যুক্ত থাকা মানুষটিকে উল্টো ‘রোষানলে’ পড়ে হত্যা মামলার আসামিও হতে হয়েছে। একের পর এক প্রোপাগান্ডায় জড়ানোর পর প্রতিষ্ঠানটির সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, ৮ জন পরিচালকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট জব্দের ফলে এর সঙ্গে যুক্ত দুই হাজার সাপ্লায়ার ও ভেন্ডর পড়েছেন বিপাকে। দেশের বিজ্ঞাপন খাতের একজন বিশ্লেষক বলছেন, যেকোনও মূল্যে প্রতিষ্ঠানটি চালু রাখতে হবে। এশিয়াটিকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের নামে যে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে—তার কোনও ভিত্তি নেই। স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে বলেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাজ পায় তারা।

‘ষড়যন্ত্রের’ সূচনা

ইস্ট এশিয়াটিক অ্যাডভারটাইজিং লিমিটেড নামে ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি ধীরে ধীরে বড় হলেও এর আগে কখনও সরাসরি ‘ষড়যন্ত্রের’ মুখে পড়তে হয়নি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর একে একে নানা অভিযোগের ঘেরাটোপে পড়ে প্রতিষ্ঠানটি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অভিযোগগুলো উত্থাপিত হয় প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। মিডিয়া ট্রায়ালের পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের অধীনে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেলে (সিআইসি) একাধিক অভিযোগ ও নোটিশ পাঠানো হয়। এরপর একে একে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ হওয়ায় ক্লায়েন্টদের টাকা অ্যাকাউন্টে আটকে গেছে। অপরদিকে প্রতিষ্ঠান তাদের ভেন্ডর ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে আগেই সম্পন্ন হওয়া ইভেন্টের জন্য টাকা পরিশোধ করতে পারছে না।

এর আগে ২০২৪ সালের ৩০ আগস্ট জার্মানি থেকে প্রকাশিত অনলাইন নিউজ পোর্টাল মিরর এশিয়া ‘বিজ্ঞাপনের বাজার ছিল এশিয়াটিকে জিম্মি, ভোল পাল্টাচ্ছেন কর্তারা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের মধ্য দিয়ে মিডিয়ায় নেতিবাচক উপস্থাপন শুরু হয় এশিয়াটিকের বিরুদ্ধে। এরপর দেশি-বিদেশি পত্রিকায় একই ধরনের তথ্য দিয়ে, কখনও চিঠিতে হুমকির মাধ্যমে, কখনও চেনা-অচেনা মানুষের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে প্রতিষ্ঠানটিকে টার্গেট করা হয়। ঘুরে ফিরে কয়েকটি জায়গায় ঘুরছে এসব অভিযোগ।

 

কত রকমের ‘প্রোপাগান্ডা’

এশিয়াটিক এমন কী করেছে যে, ২০২৪ সালে সরকার পরিবর্তনের আগে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ উপস্থাপন না করে, পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ শুরু হলো। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবি উত্থাপন করা হয়— এশিয়াটিক মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মাননার জন্য নকল স্বর্ণপদক সরবরাহ করেছে। যদিও এশিয়াটিক তথ্যপ্রমাণ হাজির করে বরাবরই এই দাবিকে ভিত্তিহীন বলে আসছে। তারা বলছে, অনুষ্ঠানটির জন্য স্বর্ণপদক একটি পৃথক সরকারি ক্রয় কমিটির মাধ্যমে অ্যামিকন নামের কোম্পানি থেকে কেনা হয়েছিল— যা দেশের সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্বের রাষ্ট্রনায়ক, রাজনীতিবিদ, চিন্তাবিদ, দার্শনিক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী এবং বিশিষ্ট নাগরিকদের হাতে যে স্বর্ণপদক তুলে দেওয়া হয়েছিল— সেগুলো এশিয়াটিক নয়, অন্য একটি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করেছিল।

এশিয়াটিকের বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ, তারা ‘বিতর্কিত সংস্থা’ সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) সঙ্গে ‘জয় বাংলা কনসার্ট’ আয়োজন করেছে। কিন্তু বাস্তবে এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের কোনও সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসব কনসার্ট আয়োজনের সঙ্গে জড়িত ছিল না বলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে জানানো হয়। গত কয়েক বছর ধরে সব ‘জয় বাংলা কনসার্ট’ আয়োজন করেছে গ্রে বাংলাদেশ লিমিটেড এবং ব্লুজ কমিউনিকেশনস লিমিটেড। এমনকি এশিয়াটিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষের অনুষ্ঠান নিয়েও।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই কাজটি এশিয়াটিক এককভাবে পরিচালনা করেনি। সরকারি ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী টেন্ডারের মাধ্যমে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়, যেখানে ৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্য থেকে মূল্যায়নে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে এশিয়াটিক, গ্রে বাংলাদেশ লিমিটেড ও কে-স্পোর্টস লিমিটেড নির্বাচিত হয়।

 

আসলেই বিজ্ঞাপনের বাজার দখলে রেখেছিল?

এশিয়াটিকের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিযোগ— প্রতিষ্ঠানটি বিজ্ঞাপনের বাজার দখল করে রেখেছিল। ভুক্তভোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেঞ্চমার্কের স্বত্বাধিকারী আশরাফ কায়সার শুরু থেকেই ন্যায়বিচারের দাবিতে সোচ্চার। একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের অভিযোগ উত্থাপনের প্রক্রিয়া কী হতে পারে— প্রশ্নটি নিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে মোবাইলে তা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী সময়ে টেক্সট করে কল করার কারণ জানিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে অসমর্থিত সূত্র বলছে, তিনি অসুস্থ।

বাজার দখল প্রসঙ্গে এশিয়াটিকের গ্রুপ নির্বাহী পরিচালক জোবায়ের বাবু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘এশিয়াটিক কোনও ভুঁইফোড় কোম্পানি নয়, আমরা সার্ভিসের ক্ষেত্রে গুণগত মান নিয়ে কম্প্রোমাইজ করি না। স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে বলেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাজ পাই।’’

কী ধরনের হয়রানির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের প্রায় দুই হাজারের মতো সাপ্লায়ার ও ভেন্ডর রয়েছে। কাজ শেষে রাজস্ব বোর্ডের সিআইসিতে জমা দেওয়া ইনভয়েসের ভিত্তিতে আমরা তাদের পে করতে পারছি। এভাবে কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু এটা স্বাভাবিক অপারেশন না। আমরা এটুকু করতে পারায় তাদের ধন্যবাদ জানাই। অনেক সময় ভেন্ডরদের অ্যাডভান্স দিয়ে কাজ করাতে হয়। এখন সেটা পারছি না। তারপরও আমরা কাজটা সহজ করতে পছন্দ করি।’’

লাগাতার প্রোপাগান্ডা মোকাবিলার বিষয়টিকে তিনি বিচ্ছিন্ন কোনও ঘটনা মনে করেন না, উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘এটাকে আমি সমগ্র গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখি। এটার সঙ্গে কারও কারও ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত। যারা বলেন, আমরা সিআরআই’র কাজ করেছি, তারা কেবল বলে দিলেই তো হবে না। প্রমাণ হাজির করতে হবে। মুখ আছে তাই বলে দিলাম— এভাবে রাষ্ট্র চলে না। এভাবে ইন্ডাস্ট্রি চলে না। যারা কেবল কথা দিয়ে এশিয়াটিকের মতো বড় কোম্পানিকে ঘায়েল করতে চান, তারা কিন্তু গত ১৬ বছর নানা সুবিধা নিয়েছেন। যারা রাতারাতি এশিয়াটিকের মতো হয়ে যাবে ভাবছেন, তাদের কাজ দেখিয়ে বড় হতে হবে।’’

গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সরাসরি কাজের বিষয়ে  জোবায়ের বাবু বলেন, ‘‘আমরা গণমাধ্যমগুলোকে যে টাকা দেই, সেটা ক্লায়েন্টের কাছ থেকে নিয়ে দিয়ে থাকি। সেই প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ায় মিডিয়াগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এশিয়াটিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতেই পারে। সেটি আইনিভাবে আমরা মোকাবিলা করতে প্রস্তুত। কিন্তু ব্যবসা বন্ধ করে তদন্ত করবেন কেন? সেদিক থেকে এনবিআর আমাদের একটা পথ দেখিয়ে দিতে পেরেছে, সেটা অনেকটা কাজের হয়েছে।’’

 

তাই বলে হত্যা মামলা?

‘ক্ষমতা খাটিয়ে কাজ বের করা’, ‘বিজ্ঞাপনের বাজার একচেটিয়া দখল’সহ নানা ধরনের অভিযোগের পর এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি’র গ্রুপ ম্যানেজিং ডিরেক্টর ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের সময় এক শ্রমিকের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা করা হলে— সরকার, সুশীল সমাজ ও তার গণমাধ্যম সহকর্মীরা বিস্ময় প্রকাশ করেন। মামলায় তিনি ১৫৭তম আসামি। সাক্ষীদের বেশ কয়েকজন এই মামলা সম্পর্কে ‘অজ্ঞতা’ প্রকাশ করেছেন এবং কেউ কেউ জানিয়েছেন, ‘নাম দিতে বলা হয়েছিল বলেই দিয়েছেন’। এসব মামলায় বিস্ময়, উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও। ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান সে সময় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে লেখেন, ‘‘ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে এই ফৌজদারি মামলা হলো। সব কিছু ভীষণভাবে ভুল পথে যাচ্ছে, এটি তার আরেকটি উদাহরণ।’

 

প্রতিযোগিতায় না এসে ট্যাগ দিয়ে প্রতিশোধ

ইন্ডাস্ট্রির একাধিক ব্যক্তি ‘এশিয়াটিকের মনোপলি ব্যবসা’ নিয়ে কারও কারও সরাসরি অবস্থানকে দৃষ্টিকটু বলে উল্লেখ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘‘এশিয়াটিক বিজনেস বড় করেছে। সেটা আপনার ঈর্ষার জায়গা হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিজনেস বড় করাটা তার অপরাধ নয়। একটা প্রতিষ্ঠানকে গড়তে কতদিন লাগে, এর সঙ্গে কত মানুষ জড়িত। হুট করে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টাটা খুবই দৃষ্টিকটু। এমনকি এশিয়াটিকের গণমাধ্যম ক্লায়েন্টরাও বিপদে আছেন।’’

সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক মাসুদ কামাল মনে করেন, ‘‘কেউ কেউ ব্যক্তিগত ব্যবসায়িক প্রতিহিংসায় জয়ী হতে জুলাই আন্দোলনকে সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করছেন। এশিয়াটিকের ইরেশ যাকেরের বিরুদ্ধে যে মামলা, সেটা যে পাতানো বোঝাই যায়। যখন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়, তখন এটুকু বোঝা যায় যে— এই সরকার সুবিচারের চেয়ে প্রতিশোধপরায়ণতাকে সহায়তা করতে চায়। এশিয়াটিকের সঙ্গে আসাদুজ্জামান নূরের সম্পর্ক আছে, সে জন্য তার কর্মীরা হয়রানির মধ্যে পড়ুক সেটা কাম্য নয়। প্রতিষ্ঠানকে চালু রাখতে হবে। এ মানুষগুলো জাতীয় সম্পদ ধ্বংসের মাধ্যমে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে। এশিয়াটিকের সঙ্গে গণমাধ্যমগুলোর সম্পর্ক আছে। আমি জানি, অনেক গণমাধ্যম বিল পরিশোধ করতে পারছে না, ফলে গণমাধ্যমগুলোর সোচ্চার হওয়া জরুরি।’’

মন্তব্য করুনঃ


সর্বশেষ সংবাদ











-->