• ঢাকা
  • |
  • বৃহঃস্পতিবার ১৪ই চৈত্র ১৪৩০ সন্ধ্যা ০৬:২৬:০১ (28-Mar-2024)
  • - ৩৩° সে:

শামীমার লড়াই এবং আরও লড়াই


বুধবার ৭ই সেপ্টেম্বর ২০২২ রাত ০৩:৫০



শামীমার লড়াই এবং আরও লড়াই

শামীমা আখতার ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

সবকিছুর শুরুটা ব্রুস লিকে দিয়ে।

শামীমা আখতার তখন ক্লাস ফোর বা ফাইভে পড়তেন। মেজ ভাইয়ার ঘরে মার্শাল আর্ট তারকার একটা পোস্টার দেখে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ভাইয়া, এই লোকটা কে?’

ভাই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ওর নাম ব্রুস লি। ও মার্শাল আর্ট জানে। খালি হাতেই বাঘের সঙ্গে লড়াই করতে পারে।’

হোক সিনেমার কল্পকাহিনি। তবু ছোট্ট মেয়েটার মাথায় ঢুকে গিয়েছিল—শরীরচর্চার এই কৌশল আমাকেও শিখতে হবে।

সেদিন যদি শামীমার মাথায় এই ভূত না চাপত, তাহলে কি এত বাধা পেরিয়ে কারাতে শিখতেন? পাঁচবার জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতেন?

বয়স ৫০-এর কাছাকাছি। নানা অসুখ–বিসুখের সঙ্গে লড়াই করে, ছেলে তাহসিন শানকে সঙ্গে নিয়ে এখনো শরীরচর্চা, যোগব্যায়াম, মার্শাল আর্ট নিয়ে আছেন। এ বছর এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক কারাতের প্রতিযোগিতা ওজাওয়া কাপে অংশ নিয়েছেন দুজন। মা-ছেলে দুজনই পেয়েছেন ব্রোঞ্জপদক।

কিন্তু বিশ্বাস করুন, জীবনের এতটা পথ পেরোতে গিয়ে কারাতের চেয়ে আরও অনেক কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি শামীমাকে হতে হয়েছে। যে লড়াইয়ে কোনো পদক মেলে না।

জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় পাঁচবার  চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন শামীমা আখতার
জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন শামীমা আখতারছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ভূতের গলির ‘অ্যাডভেঞ্চার’

শামীমা আখতারের বাবা মো. সেকান্দার ছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডেপুটি ডিরেক্টর। সরকারি চাকরির সুবাদে ছয় ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে থাকতেন সিলেটে। সে সময় শামীমার মাথায় ‘মারামারির ভূত’ চেপেছিল ঠিকই, কিন্তু সিলেটে কারাতে শেখার কোনো সুযোগ ছিল না। তা ছাড়া বাবা সাফ সাফ বলে দিয়েছিলেন, ‘ওসব মারামারি শেখা লাগবে না। পড়ালেখায় মন দাও।’

শামীমা যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন, তখন পুরো পরিবার চলে এল ঢাকায়। একদিন পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন তাঁর চোখে পড়ল, ‘জাতীয় জুডো ও কারাতে সেন্টারে ভর্তি চলছে।’ ঠিকানা? ভূতের গলি।

সদ্য ঢাকায় পা রাখা কিশোরীর কাছে ভূতের গলি নামটাই যথেষ্ট ভীতিকর ছিল। তবু সাহস করে মেজ বোনকে সঙ্গে নিয়ে একদিন চুপি চুপি ভূতের গলি কমিউনিটি সেন্টারে হাজির হন।

গিয়ে দেখেন এলাহি কারবার! ৫০-৬০ জন ছেলে মিলে বিকট হা-হু শব্দ করে কারাতে শিখছে। প্রশ্নবোধক চোখে তাকিয়ে প্রশিক্ষক শুরুতেই জানিয়ে দেন, ‘এখানে কিন্তু আর কোনো মেয়ে নেই। তোমার বাসা থেকে শিখতে দেবে তো? আমরা কিন্তু গার্ডিয়ানের স্বাক্ষর ছাড়া ভর্তি নেব না।’

১৯৮৬-৮৭ সালের কথা। বাবার স্বাক্ষর নকল করে কারাতে শিখতে ভর্তি হয়ে যান শামীমা।

‘আব্বা যেন না জানে’

সে এক অ্যাডভেঞ্চার বটে। স্কুল ছুটির পর কোচিংয়ের নাম করে কারাতে শিখতে যেতেন শামীমা। রিকশার পথটুকু হেঁটে পেরিয়ে যেটুকু টাকা বাঁচে, সেটাই সম্বল। বাড়িতে কেউ যেন না জানে, সে জন্য কারাতের পোশাকটা ‘নিষিদ্ধ বস্তু’র মতো স্কুলব্যাগে লুকিয়ে রাখতে হতো। প্রশিক্ষণকেন্দ্রের পাশেই ছিল এক রিকশাচালকের বাড়ি। সে বাড়ির কর্ত্রীর সঙ্গে সখ্য করে নিয়েছিলেন তিনি। স্কুল ছুটির পর সোজা সেখানে গিয়ে পোশাক বদলে নিতেন। প্রশিক্ষণ শেষে, ফেরার সময় আবার স্কুল ড্রেস পরে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বাড়ি ফিরতেন।

বাসায় কেউ টের পায়নি? প্রশ্ন শুনে হেসে ফেললেন শামীমা। ‘টের পায়নি আবার? একদিন তো বড় বোন আমার কারাতের ড্রেস চুলার আগুনে ফেলে দিয়েছিল। মা আবার তুলে রেখেছে। মায়েদের তো আসলে কোনো কিছু চোখ এড়ায় না। আমি যে হাতে-পায়ে কাটাছেঁড়া নিয়ে বাসায় ফিরি, তিনি তো ঠিকই দেখেছিলেন। কিন্তু খেলাটা যে আমি খুব ভালোবাসি, সেটাও নিশ্চয়ই বুঝেছেন। মা কিছু বলেননি। আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছিল—আব্বা যেন না জানে।’

শেষ পর্যন্ত আব্বা কিন্তু ঠিকই জেনে গিয়েছিলেন।

১৯৮৯ সালের এক রাতের কথা। খেলায় মার খেয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে, রাত দশটায় দুরুদুরু বুকে বাড়ি ফিরেছিলেন শামীমা। আব্বার সামনে দাঁড়িয়েই বুঝতে পারছিলেন, ‘আজকে খবর আছে!’

খবর সত্যিই ছিল। সেদিনই রাত আটটার খবর দেখতে বসে বাবা জেনেছিলেন, তাঁর ছোট মেয়ে কারাতে শেখে। শুধু তাই নয়, জাতীয় কারাতে প্রতিযোগিতায় সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে!

নতুন লড়াই

চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরও শামীমার বাড়িতে কারাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়নি। তিনি বলছিলেন, ‘তখন বাড়িতে আমি সবার ছোট। বড়রা সবাই স্ট্যান্ড করা, লেটার মার্কস পাওয়া। বুঝতেই পারছেন, পড়ালেখার ব্যাপারে কী রকম চাপ ছিল আমার ওপর। ও, বলে রাখি। আমার দুই বড় ভাই-বোন ডাক্তার। বাকিরাও ভালো অবস্থানে আছেন। সে জন্য আমার মা রওশন আরা বেগম রত্নগর্ভা পুরস্কার পেয়েছেন।’

মন্তব্য করুনঃ


সর্বশেষ সংবাদ