• ঢাকা
  • |
  • বৃহঃস্পতিবার ৫ই বৈশাখ ১৪৩১ রাত ০৯:০৩:৩১ (18-Apr-2024)
  • - ৩৩° সে:

জন্মশতবর্ষে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সেই মেয়েটি


বুধবার ৭ই সেপ্টেম্বর ২০২২ রাত ০৩:৫৩



জন্মশতবর্ষে লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের সেই মেয়েটি

জাহান আরা রহমান

ফুলের কারুকাজ করা একটি নীল রঙের শাড়ি পরে সোফা-কাম চেয়ারে বসেছিলেন তিনি। বয়স তাকে কাবু করতে পারেনি। হালকা পাতলা শরীর। চোখে চশমা। আমরা কক্ষে ঢুকে সালাম দিতেই হাত তুলে প্রত্যুত্তর দিলেন।

প্রথম সাক্ষাতেও মনে হলো অনেক দিনের চেনা। স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি বলছি, কিছু মনে করবে না তো।’

আমাদের সামনে বসে আছেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী। বললাম, আপনার শৈশবের গল্প, কৈশোরের গল্প শুনতে চাই। তিনি এক এক করে বলতে থাকলেন। কোনো জড়তা নেই। তবে অনেক কিছু মনে করতে পারেন না। সূত্র ধরিয়ে দিলে বলতে পারেন।

আমরা বলছি জাহান আরা রহমানের কথা। কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। নিজেকে ব্রেবোর্নিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করেন। সেখান ইন্টারমিডিয়েট ও স্নাতক পড়েছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএতে ভর্তিও হলেও পড়াশোনা আর এগোয়নি। ১৯৪৬ সালে কলকাতার ট্রপিক্যাল মেডিকেল স্কুলের চিকিৎসক মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়।

সে সময় কলকাতায় মেয়েদের বেশ কয়েকটি কলেজ ছিল। বেথুন, স্কটিশ চার্চ, ভিক্টোরিয়া, গোখেল মেমোরিয়াল ইত্যাদি। কিন্তু মুসলিম মা-বাবা ওসব কলেজে মেয়েকে পড়াতে চাইতেন না। এই প্রেক্ষাপটে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৯৩৯ সালে পার্ক সার্কাসে মুসলিম মেয়েদের জন্য আলাদা কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেন। মুসলিম মেয়েরা পর্দা রক্ষা করে কলেজে আসতেন বলে এর নাম হলো ‘পর্দা কলেজ।’ তৎকালীন গভর্নর লর্ড ব্রেবোর্ন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন। পরে লেডি ব্রেবোর্নের নামেই এটি পরিচিত পায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে এ কলেজের মেয়েরাই শিক্ষাদীক্ষা, রাজনীতি, সাহিত্য ও সমাজসেবায় বড় ভূমিকা রাখেন।

দেশ বিভাগের পর জাহান আরা স্বামী মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন এবং নানা সমাজসেবামূলক কাজে জড়িয়ে পড়েন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নুনের স্ত্রী ভিকারুননিসা নুনের নেতৃত্বে ঢাকায় যে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতেও জাহান আরার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিভাবকদের বোঝাতেন, কেন কন্যা সন্তানকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। পঞ্চাশের দশকে খুলনায় বন্যা হলে তাঁর নেতৃত্বে একদল স্বেচ্ছাসেবী ঢাকা থেকে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলেন।

১৯৬০-এর দশকে জাহান আরা রহমান অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (এপিডব্লিউএ) পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানের মারিতে সংগঠনটির সাধারণ সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। জাহান আরা ষাটের দশকে উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউভিএ) সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশে ডব্লিউভিএ’র সভাপতি নির্বাচিত হন এবং লালমাটিয়ায় মেয়েদের জন্য ডব্লিউভিএ কলেজ স্থাপনে নেতৃত্ব দেন। তাঁর ছোট বোন নার্গিস খান এই কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বে ডব্লিউভিএ ঢাকার উপকণ্ঠ বাসাবোতে মেয়েদের বৃত্তিমূলক শিক্ষার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

বাইরে যাই হোক না কেন কলেজে হিন্দু ও মুসলমান মেয়েদের মধ্যে অত্যন্ত প্রীতির সম্পর্ক ছিল। কলেজে কখনো দুই সম্প্রদায়ের ছাত্রীদের মধ্যে গোলযোগ হয়নি? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘নেভার, নেভার, নেভার।’

জাহান আরা রহমান কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। নিজেকে ব্রেবোর্নিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করেন
জাহান আরা রহমান কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী। নিজেকে ব্রেবোর্নিয়ান হিসেবে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করেন

আশির দশকে কয়েকজন সাবেক শিক্ষার্থীর উদ্যোগে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ব্রেবোর্স ওল্ড স্টুডেস্ট অ্যাসোসিয়েশন। জাহান আরা ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক। ১৯৯৪ সালে তিনি এর সভানেত্রী নির্বাচিত হন। তাঁর উদ্যোগে ব্রেবোর্ন বিচিত্রা নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সালে নুরজাহান বেগমের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বেগম পত্রিকা। জাহান আরা নিয়মিত এই পত্রিকায় কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ লিখতেন। আশির দশক পর্যন্ত তাঁর লেখালেখি অব্যাহত ছিল। বেগমের সাহিত্য সভাগুলোতেও তিনি যেতেন। জাহান আরাকে বেশ সমীহ করতেন নূরজাহান, কারণ তিনি ছিলেন তাঁর কয়েক বছরের অনুজ।

জাহান আরা রহমানের পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম। বাবা ছিলেন কলকাতার ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রট। সরকারি চাকরি যেহেতু বিভিন্ন স্থানে বদলি হতে হতো। মেয়েও তার সঙ্গে যেতেন। মা প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তেমন না করলেও রাত জেগে বই পড়তেন এবং মেয়েকে পড়তে উৎসাহিত করতেন। বাবা যখন দার্জিলিং ছিলেন, তখন সেখানে হাইস্কুল ছিল না। জাহান আরাকে ভর্তি করা হলো জলপাইগুড়ি হাইস্কুলে। সে সময়ে পড়াশোনার মাধ্যম ছিল ইংরেজি। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে তিনি ফার্সির বদলে সংস্কৃত নিলেন। মুসলমান মেয়ে সংস্কৃতি নিয়ে পড়েছেন, এ রকম উদাহরণ খুব বেশি নেই। প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেই ভর্তি হলেন ব্রেবোর্ন কলেজে।

মন্তব্য করুনঃ


সর্বশেষ সংবাদ