• ঢাকা
  • |
  • বুধবার ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ সন্ধ্যা ০৭:০৯:২৫ (15-May-2024)
  • - ৩৩° সে:

রহস্যময় সিন্দুক ‘তাবুত’ বা ‘অলৌকিক সিন্দুক’


বৃহঃস্পতিবার ১৭ই আগস্ট ২০২৩ রাত ০৮:৪৬



রহস্যময় সিন্দুক ‘তাবুত’  বা ‘অলৌকিক সিন্দুক’

ছবি সংগৃহীত

‘অলৌকিক সিন্দুক’ বা ‘আর্ক অব দ্য কোভেন্যান্ট’। আরবিতে এবং কুরআনের ভাষায়- ‘তাবুত’। রহস্যময় এই সিন্দুকের ব্যাপারে মুসলিম, ইহুদি, খৃস্টান- তিনটি ধর্মের অনুসারীরাই একমত যে, এ সিন্দুকটির অস্তিত্ব আছে এবং এটি অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন। আল্লাহর পক্ষ থেকে রহস্যময় এ সিন্দুকটি বনি ইসরাইল সম্প্রদায়কে প্রদান করেছিলেন তাদের নবি হজরত মুসা [আ.]।

Ark of the Covenant বা Ark of the Testimony বা চুক্তির সিন্দুক পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় একটি বস্তু। বাইবেলে এর পরিচিতি হিসেবে বলা আছে যে এটি কাঠের বাক্স বা সিন্দুক যা আড়াই হাত লম্বা, দেড় হাত চওড়া এবং দেড় হাত উচ্চতা বিশিষ্ট (21⁄2×11⁄2×11⁄2 royal cubits or 1.31×0.79×0.79 m)। এর উপরিভাগ স্বর্ণের আবরণে আবৃত ছিল। এর সাথে চারটি স্বর্ণের রিং সংযুক্ত ছিল যার দ্বারা আর্কটি বহন করা হতো। আর্কটি প্রথমে চামড়া এবং এর উপর নিল রঙের বিশেষ কাপড় দিয়ে মোড়ানো থাকতো এবং সবসময় এটি একটি কাপড় দিয়ে আচ্ছাদিত থাকতো যাতে এটি বহনকারী পুরোহিতরাও এটি দেখতে না পারে।

বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী তূর পর্বতে আল্লাহর সাথে মুসা (আঃ) এর সাক্ষাতের সময় আল্লাহর আদেশ এবং নির্দেশনা অনুযায়ী মুসা (আঃ) এটি নির্মাণ করেন। অবশ্য এটি নিয়েও প্রত্নতাত্মিকদের দ্বিমত আছে। ধারনা করা হয় এই আর্কের ভেতর দশটি আদেশ বা আইনের নথি ( Commandments Tablet) সংরক্ষিত ছিল। Book of Exodus এবং Book of Numbers এর সনাতনী ব্যাখ্যা থেকে জানা যায় যে আর্কটিতে হারুন (আঃ) এর যষ্টি, একটি অমৃতের কলস এবং মুসা (আঃ) এর স্বহস্তে লিখিত তাওরাত কিতাব সংরক্ষিত ছিল।

কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় আছে সেই রহস্যময় অলৌকিক সিন্দুক? কেন তাকে হাজার বছর ধরেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? প্রতি শতাব্দীতে হাজারও রহস্যভেদী মানুষ সেই সিন্দুকটির খোঁজ করেছেন, কিন্তু পেয়েছেন বলে শোনা যায়নি। এখনও একদল রহস্যসন্ধানী লোক সিন্দুকটি হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। খৃস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে নবি মুসার মৃত্যুর পর তার সান্নিধ্যধন্য নবি ইউশা ইবনে নুন সিন্দুকটির তত্ত্বাবধান করতেন। তার মৃ'ত্যুর পর বনি ইসরাইল সম্প্রদায়ের পুরোহিতগণ এটি দেখাশোনা করতেন। কেননা এই সিন্দুকের অলৌকিক ক্ষমতা ছিলো বলে তারা বিশ্বাস করতো।

তারা বিশ্বাস করতো, এই সিন্দুক সঙ্গে থাকলে কেউ তাদের পরাজিত করতে পারবে না এবং তারা সবার ওপর বিজয় অর্জন করবে। বেশ কিছু বছর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যুদ্ধের সময় সিন্দুকটি তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা সিন্দুকটি নিয়ে বি'পাকে পড়ে। কেননা যেখানেই সেটি রাখা হতো তার আশেপাশের লোকজনের মধ্যে মহামারী প্লেগ ছড়িয়ে পড়তো।

এভাবে বেশ কিছুদিন তারা সিন্দুকটিকে বিভিন্ন স্থানে স্থানান্তরিত করে, একই ফল পাওয়া যায়। অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটে। উপায়ন্তর না দেখে তারা সিন্দুকটিকে একটি গরুর গাড়িতে করে অজানার উদ্দেশে পাঠিয়ে দেয়। এরপর এটি বাদশাহ তালুতের হস্তগত হয়। তিনি একজন ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ ছিলেন। 

কুরআনে তার এবং সিন্দুকটির বর্ণনা এসেছে- وَقَالَ لَهُمْ نَبِيُّهُمْ إِنَّ آَيَةَ مُلْكِهِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ التَّابُوتُ فِيهِ سَكِينَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَبَقِيَّةٌ مِمَّا تَرَكَ آَلُ مُوسَى وَآَلُ هَارُونَ تَحْمِلُهُ الْمَلَائِكَةُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَةً لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘বনি-ইসরাইলদেরকে তাদের নবি আরো বললেন,তালুতের নেতৃত্বের চিহ্ন হলো এই যে, তোমাদের কাছে একটা সিন্দুক আসবে যাতে থাকবে তোমাদের পালকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের মনের প্রশান্তি, আর তাতে থাকবে মুসা, হারুন এবং তাঁদের সন্তানবর্গের পরিত্যক্ত কিছু সামগ্রী। সিন্দুকটিকে বয়ে আনবে ফেরেশতারা। তোমরা যদি ঈমানদার হয়ে থাক, তাহলে এতে তোমাদের জন্য নিশ্চিতই পরিপূর্ণ নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা বাকারা, আয়াত ২৪৮) 

এ প্রসংগে বাইবেলের বর্ণনা কুরআন থেকে বেশ কিছুটা বিভিন্ন । তবুও এ থেকে আসল ঘটনার যথেষ্ট বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এক যুদ্ধে ফিলিস্তিনীরা বনী ইসরাঈলদের থেকে এটি ছিনিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের যে শহর ও যে জনপদে এটি রাখা হতো সেখানেই মহামারীর প্রাদুর্ভার হতে থাকতো ব্যাপক ভাবে। অবশেষে তারা সিন্দুকটি একটি গরুর গাড়ির ওপর রেখে হাঁকিয়ে দিয়েছিল। সম্ভবত এ বিষয়টিকে কুরআন এভাবে বর্ণনা করেছে যে, সেটি তখন ফেরেশতাদের রক্ষণাধীনে ছিল কারণ সেই গাড়িটিতে কোন চালক না বসিয়ে তাকে হাঁকিয়ে দেয়া হয়েছিল। আর আল্লাহর হুকুমে এটিকে বনী ইসরাঈলদের দিকে নিয়ে আসা ছিল ফেরেশতাদের কাজ। আর এই সিন্দুকের মধ্যে রয়েছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য মানসিক প্রশান্তির সামগ্রী, একথার অর্থ বাইবেলের বর্ণনা থেকে যা পাওয়া যায় তা হচ্ছে এই যে, বনী ইসরাঈল এই সিন্দুকটিকে অত্যন্ত বরকতপূর্ণ এবং নিজেদের বিজয় ও সাফল্যের প্রতীক মনে করতো। এটি তাদের হাতছাড়া হবার পর সমগ্র জাতির মনোবল ভেঙে পড়ে। প্রত্যেক ইসরাঈলী মনে করতে থাকে, আমাদের ওপর থেকে আল্লাহর রহমত উঠে গেছে এবং আমাদের দুর্ভাগ্যের দিন শুরু হয়ে গেছে। কাজেই সিন্দুকটি ফিরে আসায় সমগ্র জাতির মনোবল ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। তাদের ভাঙা মনোবল আবার জোড়া লেগে যায়। এভাবে এটি তাদের মানসিক প্রশান্তির কারণে পরিণত হয়। ''মূসা ও হারুণের পরিবারের পরিত্যক্ত বরকতপূর্ণ জিনিসপত্র'' এই সিন্দুকে রক্ষিত ছিল। এর অর্থ হচ্ছে, 'তূর-ই-সিনাই'-এ (সিনাই পাহাড়) মহান আল্লাহ হযরত মূসাকে পাথরের যে তখতি গুলো দিয়েছিলেন। এ ছাড়াও হযরত মূসা নিজের লিখিয়ে তাওরাতের যে কপিটি বনী লাভীকে দিয়েছিলেন সেই মূল পাণ্ডুলিপিটিও এর মধ্যে ছিল। একটি বোতলে কিছুটা ''মান্না'ও এর মধ্যে রক্ষিত ছিল, যাতে পরবর্তী বংশধররা আল্লাহর সেই মহা অনুগ্রহের কথা স্মরণ করতে পারে, যা মহান আল্লাহ ঊষর মরুর বুকে তাদের বাপ দাদাদের ওপর বর্ষণ করেছিলেন। আর সম্ভবত অসাধারণ মুজিজা তথা মহা অলৌকিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু হযরত মূসার সেই বিখ্যাত 'আসা' বা লাঠিও এর মধ্যে ছিল।

এরপর সিন্দুকটি হজরত দাউদ [আ.]-এর হাতে আসে এবং তিনি তার পুত্র হজরত সোলায়মান [আ.]-কে এর তত্ত্বাবধানকারী নিযুক্ত করেন। সোলেমান (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে তাঁর উপাসনালয় (Solomon's Temple) নির্মাণের সময় তাতে আর্কটি স্থাপন এবং সুরুক্ষার জন্য একটি বিশেষ স্থান তৈরি করেন। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর ব্যাবলনিয়রা জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং Solomon's Temple ধ্বংস করে দেয়। এরপর আর্কটির সঠিক অবস্থান জানা যায়নি। বাইবেলের Book of Ezra এর ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাবলিনিয়রা জেরুজালেমের অন্যান্য সম্পদের সাথে আর্কটিও নিয়ে যায়। আবার Book of Revelation এর তথ্য অনুযায়ী ঐ সময় আল্লাহর আদেশে আর্কটি বেহেশতে স্থানান্তরিত করা হয়। এরপর সিন্দুকটির অবস্থান সম্পর্কে অনেক গুজব শোনা যায়। শোনা যায়, সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির সময় ইউরোপিয়ান নাইট টেম্পলার যোদ্ধারা সিন্দুকটি জেরুসালেম থেকে পুনরুদ্ধার করে আয়ারল্যান্ডে নিয়ে যায়। আবার কেউ কেউ মত দেন, এটি ইউথিওপিয়ার অর্থোডক্স চার্চে সুরক্ষিত আছে। কারো কারো মতে, এটি ভ্যাটিকান চার্চের গোপন কুঠুরিতে সুরক্ষিত আছে। কিন্তু এসবই গুজব যার কোনো প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। আর সিন্দুকটিও পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম রহস্যময় বস্তু হিসেবেই মানুষের মধ্যে রয়ে গেছে।

(সূত্র : তাফসিরে ইবনে কাসির, তাফসিরে মাআরেফুল কুরআন, উইকিপিডিয়া ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট] হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর [হাফেজ মাওলানা সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর অনুসন্ধানী তরুণ লেখক। ধর্মদর্শন, ইতিহাস, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় মিথ, ইতিহাসের আড়ালের ইতিহাস নিয়ে কাজ করে থাকেন। ইতোমধ্যেই ইতিহাসভিত্তিক তার লেখা বেশকিছু বই)

মন্তব্য করুনঃ